ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকে অপরিহার্য্য করে তোলে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। বস্তুত, ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর থেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য প্রথম থেকেই ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’ কার্যকরী করার চেষ্টা চালায়।
ভাগ কর ও শাসন কর নীতিঃ ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’ বলতে মূলত ব্রিটিশ সরকারের হিন্দু-মুসলিম দুটি বৃহৎ সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে শাসন করার কূটকৌশলকেই বুঝায়। এ নীতির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে এ দুটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের সদ্ভাব ও সম্প্রীতি নষ্ট করে বিরোধ স্থায়ী করা। কেননা, ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে মুসলিম জনগণ তাদের নবাবি ও শাসন ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়কে ইংরেজরা সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। সুচতুর ইংরেজ শাসকগণ এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়কে কাছে টেনে নেন এবং তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করে তুলতে থাকেন, যা হিন্দু সম্প্রদায়কে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়াতে সহায়তা করে। অতঃপর ১৮৯২ সাল থেকে শুরু হয় হিন্দু পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন। তখন কংগ্রেসের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরমপন্থি নেতাদের কার্যকলাপে ব্রিটিশ সরকার সন্দিহান হয়ে পড়ে। সুচতুর ও সাবধানী ব্রিটিশ শাসকগণ এ সময় মুসলিম জনগণকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের নীতি বা কৌশল গ্রহণ করেন। তাছাড়া হিন্দু পুনর্জাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল কলকাতাকে দুর্বল করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ শাসকগণ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; যা মুসলিম সম্প্রদায় স্বাগত জানায়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে হিন্দু সম্প্রদায় এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারপর থেকে যতবারই হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, ততবারই ব্রিটিশ সরকারের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি বা কৌশলের ফলে তা বিফল বা ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। এভাবে হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য ও সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে এবং তাকে জীবিত রেখেই ব্রিটিশ সরকার প্রায় দু’শ বছর ভারতবর্ষে তাদের ঔপনিবশিক শাসন-শোষণ, চালাতে সক্ষম হয়।
বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরাগের জন্য ইংরেজরা ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি গ্রহণ করে নি। তারা যা করেছিল ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনীতির বিকাশকে খর্ব করার এবং ভারতীয় জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে বিশৃঙ্খল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা তাদের শাসন ক্ষমতাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্বার্থকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল।