প্রাচীকালে সমগ্র বাংলার বিশেষ কোন নাম ছিল না। তখন বাংলাদেশ নামক কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। সমগ্র বাংলা জুড়ে ছিল অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং সেগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। উত্তর বাংলায় পুন্ড্র ও বরেন্দ্র; পশ্চিম বাংলায় রাঢ়, তাম্রলিপ্ত; উত্তর-পশ্চিম বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে গৌড়; দক্ষিণ বাংলায় সমতট, হরিকেল এবং পূর্ব বাংলায় বাঙ্গাল প্রভৃতি অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল। এসব দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল এবং এগুলো জনপদ নামে পরিচিত ছিল। তবে এসব জনপদের সীমা নির্দিষ্ট চিল না। যুদ্ধবিগ্রহ বা প্রাকৃতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে জনপদগুলোর সীমা ও ব্যাপ্তি পরিবর্তিত হতো।
বাংলার প্রাচীন জনপদ ও নগরসমূহঃ বিভিন্ন উৎস থেকে এ পর্যন্ত বাংলার অনেকগুলো প্রাচীন জনপদ রাজ্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

১. গৌড়ঃ গৌড় প্রাচীন বাংলার একটি সুপরিচিত জনপদ। পাণিনির গ্রন্থ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ থেকে প্রাচীন গৌড় রাজ্য ও তার সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। সাত শতকে রাজা শশাঙ্কের সময় থেকেই গৌড় রাজ্য নামটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। সেন আমলে মালদহ জেলার অন্তর্গত লক্ষণাবতী গৌড় নামে পরিচিত ছিল। হিন্দু যুগের শেষে ‘গৌড়’ ও ‘বঙ্গ’ প্রধানত এ দুভাগে সমগ্র বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। অনেকে অনুমান করেন যে, বর্তমান ভাগলপুর জেলার অন্তর্গত চম্পা নগরী ছিল গৌড় রাজ্যের রাজধানী।
২. বঙ্গঃ ঐতয়ের ‘আরণ্যক’ গ্রন্থ ও বাতাপির চালুক্যরাজাদের দলিলপত্রে সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ জনপদটি দক্সিণ-পূর্ববাংলায় অবস্থিত ছিল। এর পশ্চিম সীমা মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত কাঁসাই নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল ও সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বঙ্গের আয়তন সংকুচিত হয়। হেমচন্দ্র রচিত ‘অভিধান চিন্তামণি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ব্রক্ষপুত্র নদের পূর্ব উপকূল বঙ্গের ান্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে পাল রাজাদের আমলে বঙ্গ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যথা- উত্তর বঙ্গ এবং দক্সিণ বঙ্গ্ প্রাচীন শিলালিপি থেকে বঙ্গের দুটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়- একটি বিক্রমপুর, অন্যটি নাব্য। অবশ্য বর্তমানকালে বিক্রমপুর চিহ্নিত করা গেলেও নাব্য নামের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৩. পুন্ড্রঃ প্রাচীন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল পুন্ড্র। পুন্ড্র নামে এক প্রাচীন জাতির উল্লেখ বৈদিক গ্রন্থে এবং রামায়ণ ও মহাভারত- এ দুই মহাকাব্যে পাওয়া যায়। এরা উত্তর বাংলার অধিবাসী ছিল বলে এ অঞ্চল পুন্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত ছিল। মহাভারতের দিগ্বিজয় পর্বে বলা হয়েছে যে, গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে পুন্ড্রদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ভবিষ্যৎ পুরাণে বলা হয়েছে, গৌড়, বরেন্দ্র, নীবিতি, রাঢ়, ঝাড়খন্ড, বরাহভূমি এবং বর্ধমান – এই সাতটি প্রদেশ পুন্ড্র দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর রাজধানী ছিল পুন্ড্রনগর, বর্তমানে এই নগরীর নাম মহাস্থানগড়। পরবর্তীকালে এর নাম হয় পুন্ড্রবর্ধন।

৪. বরেন্দ্রঃ বরেন্দ্র, বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্রভূমি নামে উত্তর বাংলায় আর একটি জনপদের কথা জানা যায়্ অনুমান করা হয়, পুন্ড্রেরই একটি অংশ জুড়ে বরেন্দ্র জনপদ গড়ে উঠেচিল। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী তার ‘রামচরিত’ কাব্যে এই রাজ্যকে গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যে অবস্থিত বলে বর্ণনা করেছেন। ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বরেন্দ্র গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে অবস্থিত লক্ষণাবতী রাজ্যের অংশ বলে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে বরেন্দ্রভূমি অবস্থিত ছিল।
৫. রাঢ়ঃ ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থীত রাঢ়দেশ উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ়- এ দুই অংশে বিভক্ত ছিল। অজয় নদ ছিল দুিই রাঢ়ের সীমারেখা। শ্রীধরাচে র্যের ‘ন্যায়কান্ডালি’ গ্রন্থে দক্ষিণ রাঢ়ের উল্লেখ আছে। বর্তমান হাওড়া, হুগলি ও বর্ধমান জেলার কিছু অংশ নিয়ে দক্ষিণ রাঢ় গঠিত ছিল। রাঢ়দেশের উত্তরাঞ্চল উত্তর রাঢ় নামে পরিচিত ছিল। এ ভূখন্ড বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত কান্ডি রাঢ়দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৬. সমতটঃ পূর্ব ও দক্ষিণ – পূর্ববাংলায় বঙ্গের প্রকবেশী জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং সাত শতকের মাঝামাঝিতে সমতট ভ্রমণ করে একটি বিবরণী লিখেন। গঙ্গা ও ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত প্রসারিত ভূভাগ ছিল সমতটের অন্তর্গত। অনেকে মনে করেন, বর্তমান কুমিল্লার বড়কামতা ছিল এ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত গুপ্ত সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগ বৈস্যগুপ্ত ৫০৭- ৬-০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এভাবে স্বাধীন সমতট রাজ্যের উত্থান ঘটে।
৭. চন্দ্রদীপঃ বঙ্গের অন্তর্গত আরেকটি জনপদ হলো চন্দ্রদীপ। ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগের সুপ্রসিদ্ধ ‘বাকলা’ প্রদেশ এবং চন্দ্রদীপকে একই স্থান বলে মনে করেন। বর্তমান বরিশাল জেলায় এটি অবস্থিত ছিল। অনেকে মনে করেন, প্রাচীনকালে অনেক ভূখন্ড এ নামে পরিচিত ছিল।
৮. হরিকেলঃ হরিকেল জনপদের অবস্থান ছিল বাংলার পূর্বপ্রান্তে। সাত-আট শতক থেকে দশ-এগারো শতক পর্যন্ত হরিকেল গঙ্গা সমতটের সংলগ্ন স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। কিন্তু ত্রৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্রদীপ অধিকারের পর থেকেই হরিকেলকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। মনে করা হয়, আধুনিক সিলেটই ছিল হরিকেল জনপদ।
৯. গঙ্গারিডইঃ গ্রিক লেখকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন বাংলায় গঙ্গারিডই নামের এক শক্তিশালি রাজ্যের অবস্থান ছিল। পন্ডিতদের ধারণা, রাজ্যটি গঙ্গা নদীর তীরে কোন এক অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
১০. বঙ্গালঃ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন লিপি এবং শামস-ই-সিরাজ আফিফ রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ তে কঙ্গ এবং বঙ্গাল এ দুটি নামই আলাদাভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, “বাঙ্গালার প্রকৃত নাম ছিল বঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গের শা্সকগণ সমগ্র প্রদেশব্যাপী দশগজ উঁচু এবং বিশ গজ প্রশস্তের আল (বাঁধ) নির্মাণ করতেন। বঙ্গের সাথে এই আল শব্দের সংযোগে বঙ্গাল নামের উৎপত্তি হয়েছে।
১১. তাম্রলিপ্তঃ তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার একটি বিখ্যাত বন্দর। মহাভারতে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। মেদিনীপুর জেলায় এই বন্দরটি অবস্থিত ছিল। টলেমীর ভৌগোলিক বিবরণীতে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। এ বন্দরনগরী থেকে সমুদ্রপথে সিংহল, জাভা দ্বী, চীন প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলত।
১২. সিংহপুরঃ প্রাচীর বাঙলার নগনসমূহের মধ্যে সিংহপুরের নাম উল্লেখযোগ্য। হুগলি জেলায় এটি অবস্তিত ছিল। হুগলি জেলার সিংগুড়াই সিংহপুর ছিল বলে অনেকে অনুমান করেন।
১৩. পুষ্কর্ণঃ রামায়ণ ও মহাভারতে ‘পুষ্কর্ণ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ নগরটি দামোদর নদের দক্ষিণ তীরে অবস্তিত ছিল বলে মনে করা হয়।
১৪. কোটিবর্ষঃ প্রথম কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে এ নগরটি খ্যাতি লাভ করে। কোটিবর্ষ পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৫. পাহাড়পুরঃ পাহাড়পুর বর্তমান নওঘাঁ জেলায় অবস্থিত। পাল বংশীয় রাজা ধর্মপালের আমলে এটি সোমপুর বিহার নামে পরিচিত ছিল। সম্ভবত আট শতকে এখানে পাল রাজত্বের রাজধানী গড়ে ওঠেচিল এবং তা উপমহাদেশে মুসলিম আগমনের পূর্বপর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
১৬. মহাস্থানগড়ঃ বাংলাদেশের বর্তমান বগুড়া জেলা শহর থেকে আট মাইল উত্তরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় পনের শতক পর্যন্ত মহাস্থানগড় সমৃদ্ধিশালী জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে।
১৭. কর্ণসুবর্ণঃ কর্ণসুবর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত ছিল। সাত শতকে তাম্রলিপ্ত, পুন্ড্রবর্ধন প্রভৃতি নগরের মতো কর্ণসৃবর্ণও প্রসিদ্ধি লাভ করেচিল। এটি বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী ছিল।
১৮. বিক্রমপুরঃ বৃহত্তর ঢাকা জেলায় প্রাচীন বিক্রমপুর নগরী অবস্থিত ছিল। সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বিক্রমপুর প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এটি ছিল সেনদের দ্বিতীয় রাজধানী। বর্তমানে এটি মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত।
১৯. বঙ্গ বা বাংলার আত্মপ্রকাশঃ প্রাচীনকালে বঙ্গদেশের কোন নির্দিষ্ট সীমা বা নাম ছিল না। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে অভিহিত হতো। অবশ্য এক সময় গৌড় নামটিউ এই সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। বঙ্গাল পূর্বে পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম ছিল। বঙ্গ ও বঙ্গাল – এ দুটি নামই এক সময় দুটি পৃথক দেশের নাম ছিল। মুসলমানরা এ দেশে জয করে সমুদয় প্রদেশটিকে বঙ্গাল নামে অভিহিত করে। বঙ্গাল থেকেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামের উৎপত্তি হয়েছে।ৎ

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার অখন্ড স্বাধীন রাজ্যের ক্রমবিকাশে প্রাচনি বাংলার জনপদ ও নগরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব ক্ষুদ্র রাজ্যের সমন্বয়ে এক সময় গড়ে ওঠে স্বাধীন রাজ্য। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে স্বাধীন বঙ্গ ও গৌড় রাজ্যের উত্থান ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাংলা এ দুটি স্বাধীন জনপদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। স্বাধীন রাজ্য উত্থানের যুগে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালা শাসক।